ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত অধ্যায়ন করেছে তাদের অধিকাংশরাই বজলুল হককে চিনতো। আমরা বজলুলকে ফজুলল নামে ডেকে মজা করতাম। লম্বা চিকন দেহের ছিল বজলুল। মাথা ভর্তি চুল ছিল। টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও বাংলা একাডেমী এলাকা ছিল তার চারণ ক্ষেত্র। খুব সুন্দর উচ্চারণে কথা বলতো। আমি মাঝে মাঝে টিএসসি গেলে বজলুলকে খুঁজতাম। পেয়ে গেলে জম্পেস আড্ডা দিতাম। শুনতাম গ্রামের ছেলে বজলুলের বিস্তর অভিজ্ঞতার গল্প, পক্ষে বিপক্ষে সমালোচনা। তার কাজই ছিল যে কোন বিষয়ে তুমুল সমালোচনা করা। লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পাঠ ছিল তার দিনের প্রথম কাজ। একদিন সকাল সাড়ে ৮টায় ক্লাশ। রিকসা পাইনি। দেরী হবে ভেবে জহুরুল হক হল থেকে কলা ভবনের দিকে হাঁটা শুরু করি। দেখি বজলুল কলা ভবনের সামনের টিএসসি রোডে বসে আছে। ক্লাশের সময় পেরিয়ে যাবে। তবু বজলুলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘ এত্তো সকালে এখানে বসে কেন? বজলুল আমাকে হাত ধরে টেনে পাশে বসায়। ক্লাশ আছে বজলুল? থাক, আজ আমার জন্য ক্লাশে যাবি না। ফাদার রোজারিও স্যারের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশ। কি কি পড়াতে পারে ? কতজন ক্লাশে আসতে পারে? অনুমানে ভাবতে ভাবতে বসে পড়লাম। নাস্তা করেছ? না । টাকা নেই। চল্ নাস্তা করি। না । লাগবে না। সিগারেট খাওয়াতে পারিস। নাস্তা না খেয়ে সিগারেট খেলে ক্ষতি হবে?
তখন লিজেন্ট সিগারেট বাজারে নতুন এসেছে। মার্কেট চালু করার জন্য হলের রুমে রুমে ১০ প্যাকেট করে শুভেচ্ছা উপহার দিয়ে গেছে। আমরা রুমে দুইজন থাকি। রুমমেট খায় না। ২০টি প্যাকেট আমার। তাই পকেটে লিজেন্ট সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বেরুতাম। প্যাকেট থেকে দুটি সিগারেট বের করে দিলাম। দিয়াশালাই ওর কাছেই ছিল। একেঁ এঁেক পাঁচটি সিগারেট ধরিয়ে গাঢ় ধোঁয়া উড়াচ্ছে। বললাম কি খবর বজলুল, কিছু হয়েছে কি? সে তার ব্যাগে থেকে একটি সাদা খাতা বের করে আমাকে দেয়। প্রায় ১০০ পৃষ্টার খাতাটি। খাতার উপরে লেখা ‘আমি কেন আমার স্ত্রীকে হত্যা না করিয়া বিচ্ছেদ করিলাম’। তখন ছাত্র ছিলাম। নানা বিষয়ে কৌতূহল ছিল। কিন্তু তখন বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেইনি। কি লেখা আছে এতে? কে লিখেছে এসব? পড়ে দেখ। পড়ার সময় নেই । তুই সমালোচনা কর শুনি। বজলুল কে ষ্টাডি দিয়ে শুরু করে। আমি শুনতে থাকি। ‘আমি কেন আমার স্ত্রীকে হত্যা না করিয়া বিচ্ছেদ করিলাম’ লেখাটি আমার চাচাত ভাই লালনের লেখা। লেখাটিতে ঋতু বৈচিত্রের কথা, তদানিন্তন দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, বিয়ে, বাসর রাত থেকে বিচ্ছেদ পর্যন্ত সব প্রসঙ্গ আছে। তোমাকে পাঠিয়েছে কেন? ঢাকায় থাকি প্রকাশনীর সাথে কথা বলে লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করে দেয়ার অনুরোধ করেছে। বজলুল বলছিল, লেখাটি পাঠ করে ঘুমাতে পারিনি। সারারাত শুধু মনে হয়েছে-প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে অনেক কিছু অজানা থাকে। যা সে কাউকে বলে না। বলতে পারে না। বলা হয়ে উঠে না। নিরবে চেপে যায়। এই চাপাচাপির খেলাটাও একটি খেলা। বড় খেলা। একটু ভূল হলেই যার বিরাট ছন্দপতন। দোস্ত, এই লেখাটি ছাপানো যাবে না। এত্তো সত্য অনুভূতি ছাপানো যায় না। বললাম, লেখকের লেখার স্বাধীনতা আছে। কী এমন কথা লিখেছে যে———।
বজলুল খাতা খানা বের করে পড়ছিল, লালন তার স্ত্রীর পরিবারের বর্ননা দিয়েছে। বিয়ের আগের পরের বিষয় নিয়ে লেখার পর শ্বশুর বাড়ীতে ঘটা বাসর রাতের পর্বটি সাবলিল ভাবে লিখেছে। বাসর রাতের পরের রাতের কথায় সে লিখেছে, ফজরের আজানের পর ঘুমখানা ভাঙ্গিয়া গেল। ডিম লাইট জ্বালাইয়া ঘুমন্ত নববধু স্ত্রীকে দেখিতে লাগিলাম। বেশবাস এলোমেলো। চুলগুলো বালিশে আছঁড়িয়া পড়িয়াছে। তার সুঠাম দেহ খানা যেন আমাকে বলিতেছে ইহা তোমার! ইহা তোমার। বাতি বন্ধ করিয়া নববধু স্ত্রীকে জড়াইয়া ধরিলাম। পরম সুখে কখন চোখে ঘুম আসিয়াছে টের পাই নাই। হঠাৎ চৌকি খানা নড়িতেছে। কম্পন হইতেছে। হাত দিয়ে নববধু স্ত্রীকে খুঁজিলাম। দেখিলাম নাই। পাশ ফিরিয়া চোখ খুলিয়া দেখিতে পাইলাম ভোরের আলো অন্ধকারে আমার পায়ের কাছে নববধু স্ত্রীর সাথে একজন পুরুষ অপকর্ম চালাইতেছে। অবশ্য ইহাকে অপকর্ম বলিলে ভূল হইবে। আমার ভিতর থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। কিছুই দেখিতে পাই নাই ভাবিতে ভাবিতে চোখ বন্ধ করিয়া দোয়া কালাম পড়া শুরু করিয়া দিলাম। নববধু স্ত্রীর ডাকে বিছানা ছড়িয়া স্নান করিয়া স্বাভাবিক হইতে চেষ্টা করিতে ছিলাম। এটা কি ছাপানোর উপযোগী তুই বল দোস্ত। আমি হো হো করে হেসেছিলাম। এরপর কি লিখেছে, তার নববধু স্ত্রী বিয়ের চার বছরে কোথায়? কখন পরকীয়া করেছে তার বিস্তর বর্ণনা দিয়েছে। তবে লালন শেষে লিখেছে, পরকীয়ায় আসক্ত স্ত্রীকে একদিন হত্যা করিবার ইচ্ছা হইয়াছিল। এই ভাবিয়া তাহা দমন করিয়াছি যে, তাহারও জীবন আছে। পরকীয়ার পাপের ফল তাহাকে একদিন ভোগ করিতে হইবে। পৃথিবীতে কিংবা মরনের পরে। তাই সিদ্ধান্ত লইয়া বিয়ে বিচ্ছেদ করিয়াছি। কেহ যেন আইন ভঙ্গ করিয়া নিজের জীবনকে বিদঘুটে না করিয়া ফেলে তাই ‘আমি কেন আমার স্ত্রীকে হত্যা না করিয়া বিচ্ছেদ করিলাম’ ঘটনাবহুল বইখানা লিখিয়াছি। বললাম, লালন তার স্ত্রীর কাছে পরকীয়ার বিষয়গুলো বলেনি কেন? বলেছিল, তার স্ত্রী অস্বীকার করেছে। তাকে পাগল ইতর সংশয়বাদি পুরুষ বলে গালিগালাজ করেছে। আচ্ছা, যেহেতু সব জেনেছে তবে লালন ইচ্ছে করলেই তার স্ত্রীকে পরকীয়া পুরুষসহ ধরে ফেরতে পারত। তা করেনি কেন? লালন এ ব্যাপারে লিখেছে, পরকীয়া পুরুষসহ হাতেনাতে ধরিলে আমার বিস্তর সম্মানহানি ঘটিবে। ইহার চাইতে বিচ্ছেদই ভালো বলিয়া যুক্তিযুক্ত মনে হইয়াছে। বিচ্ছেদে সম্মানহানি কম হইবে।
গত ০৪ জুন ২০২২ রংপুরের পীরগাছায় পরকীয়া থেকে ফেরাতে না পেরে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার পর থানায় আত্মসমর্পণ করেছে এক যুবক। ২২ফেব্রুয়ারি ২০২২ পীরগাছায় স্ত্রীকে কুপিয়ে এবং স্ত্রীর ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করার পর শ্বশুরবাড়িতে আগুন দিয়ে নিজেও বিষপানে আত্মহত্যা করেন এক যুবক। কিছুদিন আগে একটি সংবাদ পড়েছিলাম পরকীয়ায় আসক্ত স্বামীর পুরুষাঙ্গ ধারালো ব্লেড দিয়ে কেঁটে দিয়েছে স্ত্রী। পীরগাছার ভয়ানক দুটি ঘটনার নেপথ্যে অনুসন্ধানী তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে বজলুলের চাচাত ভাই লালন সত্য অনুভূতি লিখেছিল। লেখাটি গল্প নয় যেন গোপন বাস্তবতা ছিল। যে কারো জীবনে মিলে যেতে পারে। স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কেউ পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে আসক্ত হলে পরিণত কখনোই শুভ হয়ে উঠবে না। ইদানিং দেশে দাম্পত্য কলহ বাড়ছে। বিচ্ছেদ বাড়ছে। মধুহীন অসাঢ় হয়ে যাচ্ছে মায়া মমতার সংসার গুলো। প্রয়োজন নৈতিকতার জাগরণ।
পুনশ্চঃ লালনের লেখাগুলো বই আকারে ছাপায়নি কোন প্রকাশনী। বজলুল চেষ্টা করেছিল।
আত্ন-কথন-৩৬
সাংবাদিক ও লেখক