অন্য কোন সংগঠনে ক্ষমতা নিয়ে চলা দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু সাংবাদিকদের সংগঠনে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিরসন করা আমাদের জন্য কঠিন। একজন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ কথা আমাকে বলার পর আমি পাল্টা প্রশ্ন করিনি। শুধু বলেছি বুঝেছি ভাই। মোটরসাইকেলের পিছনে বসে শরতের উদ্দাম বাতাস চোখে মুখে অনুভবে নিতে নিতে ভেবেছি, আমরা যারা সাংবাদিকতার পরিচয়ে মাঠ দাঁপিয়ে বেড়াই। তারা আসলেই সাংবাদিকতার মিথ জানি না। ব্যক্তি স্বার্থ, ব্যক্তি পরিচয় কিংবা ব্যক্তি উন্নয়নটাকে প্রাধান্য দেই। এ কারণেই আলোচনার দ্বারে দাঁড়াই না কিংবা আলোচনার দ্বার বন্ধ রাখি। অথচ আলোচনাই বলে দিতে পারে শেষের ঠিকানা।
আমি গোবেচারা টাইপের মানুষ। লেখালেখিতেই ব্যস্ত থাকি দিন রাতের অধিকাংশ সময়। এ জন্য অফার পাবার পরও টিভি সাংবাদিকতায় জড়াতে পারিনি। নোবেল বিজয়ী লিও টলষ্টয়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাতীয় উন্নয়নের জন্য আমাদের জন্য কিছু বলুন- লিও টলষ্টয় বলেছিল আমার তিনটি পরামর্শ আছে, পড়, পড় এবং আরো পড়। এখন আরো মনে হচ্ছে জাতীর বিবেক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক আমরা পড়িও না।
আল্লামা ইকবালের সময় এক জন কুস্তিগির ছিল যাকে গামা পালোয়ান নামে ডাকা হতো। গামা পালোয়ান দেহ থেকে ঘাম বের করার জন্য প্রতিদিন সকালে ভালো মানের নাশতা করে শারীরিক ব্যায়াম করতেন। শরীরে শক্তি ছিল এবং প্রচুর ঘাম বের হতো এ জন্য সে গর্ব বোধ করতো। আল্লামা ইকবাল তাকে একটু শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি সেমিনারে তাকে বক্তা হিসেবে আহবান করলেন। সেমিনারে তার আগে কয়েক জন বক্তা বক্তব্য পেশ করলেন। এরপর গামা পালোয়ানকে বক্তব্য দেয়ার জন্য নাম ঘোষণা করা হলো। গামা পালোয়ান ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করলেন, কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোন কথা তার মুখ দিয়ে আসছিলো না। হাঁটু কাঁপছে। ঘামে ভিজে গেছে গোটা পাজামা পানজাবি। তিনি শুধু বলছেন, আমার আগে অনেক বক্তা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন এবং পরেও গুরত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, সকলকে ধন্যবাদ।
পরের দিন আল্লামা ইকবালকে গামা পালোয়ান দেখা করে বলেছিল- ইকবাল তুমি আমাকে এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলে, আমি এই ঘাম ঝরানোর জন্য প্রতিদিন সকালে দুই-তিন ঘণ্টা পরিশ্রম করি আর এক মিনিটের বক্তব্য দিতে গিয়ে আমার শরীর থেকে এক কলসী ঘাম বের হলো। আল্লামা ইকবাল উত্তর বলেছিলেন, হে গামা পালোয়ান, জাতির জন্য তোমার মত হাজার হাজার গামা পালোয়ানের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো একজন জ্ঞানীর যে জাতিকে উন্নয়ন পুণর্জাগরণে নেতৃত্ব দিতে পারবে। যে জাতিকে মসৃন পথ দেখাবে। শক্তি দিয়ে সব অর্জন করা যায় না।
নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে সাংবাদিক নামের আমরা জ্ঞানের দরজা থেকে দূরে সরে গেছি। অথচ সাধারণ জনগণ অনেক জানি বলে খুব মূল্যায়ন করেন আমাদের। স্নেহের শাহরিয়ার মিমের একটি কথা মনে ধরেছে- আপনারা নিজেরা ঝগড়া করবেন, মারামারি করবেন আমরা প্রশ্ন বানে বিদ্ধ হবো। এ কেমন কথা। ছেলেটা এখনো লোভের কাছে নতজানু হয়নি। তাঁর বিবেক বেঁচে আছে। এ জন্যই সরল কথা বলেছে।
আমি শুধু আল্লামা ইকবালের মতো বলতে চাই, জাতির জন্য হাজার হাজার শক্তিশালী সাংবাদিকের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন শুধু কিছু জ্ঞানী সাংবাদিকের।
আত্নকথন-২৭
সাংবাদিক ও লেখক